বর্তমান যুগে তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের সাথে সাথে বাংলাদেশে যে ব্যবসাটি সবচাইতে দ্রুত জনপ্রিয় এবং লাভজনক হয়ে উঠেছে, তা হলো অনলাইন কম্পিউটার দোকান ব্যবসা। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে শহরের ব্যস্ত মার্কেট—সবখানেই কম্পিউটার, ফটোকপি, এবং অনলাইনের সেবার চাহিদা ব্যাপক।
আপনি কি বেকারত্ব দূর করতে বা নিজস্ব উদ্যোগে কিছু করতে চাচ্ছেন? তাহলে কম্পিউটার বা ফটোকপি ব্যবসা শুরু করার পদ্ধতি জানা আপনার জন্য জরুরি। এটি এমন একটি ব্যবসা যেখানে পুঁজি মোটামুটি হলেও মেধা এবং পরিশ্রম দিয়ে ভালো আয় করা সম্ভব। আজকের এই আর্টিকেলে আমরা আলোচনা করব—একটি সফল কম্পিউটার দোকান দিতে কি কি সরঞ্জাম লাগে, খরচ কেমন হয়, এবং কম্পিউটার দোকানের কাজের তালিকা সম্পর্কে বিস্তারিত।
কেন শুরু করবেন অনলাইন কম্পিউটার ও ফটোকপির দোকান?
বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি সব কাজই অনলাইন নির্ভর হয়ে পড়েছে। জন্ম নিবন্ধন থেকে শুরু করে চাকরির আবেদন, জমির খতিয়ান তোলা কিংবা পাসপোর্ট আবেদন—সবই এখন অনলাইনে। সবার ঘরে কম্পিউটার বা প্রিন্টার থাকে না, আবার থাকলেও সবাই সব কাজ পারেন না। এখানেই একজন দক্ষ কম্পিউটার অপারেটরের প্রয়োজন হয়।
১. কম্পিউটার দোকান ব্যবসা শুরু করতে কি কি সরঞ্জাম প্রয়োজন?
একটি সফলভাবে কম্পিউটার দোকান ব্যবসা পরিচালনা করতে হলে আপনাকে সঠিক হার্ডওয়্যার বা যন্ত্রপাতি কিনতে হবে। নিচে একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা দেওয়া হলো:
ক) ডেস্কটপ কম্পিউটার বা ল্যাপটপ
দোকানের মূল চালিকাশক্তি হলো কম্পিউটার। খুব হাই-এন্ড গেমিং পিসির দরকার নেই, তবে কাজ যাতে দ্রুত হয় সেজন্য মোটামুটি ভালো কনফিগারেশন লাগবে।
- প্রসেসর: কমপক্ষে Core i3 (10th Gen) অথবা Core i5 (6th Gen এর উপরে)।
- র্যাম: কমপক্ষে 8GB (ডিডিআর ৪)।
- স্টোরেজ: উইন্ডোজের জন্য 120GB/256GB SSD (বধ্যতামূলক) এবং ফাইল রাখার জন্য 500GB/1TB HDD।
- মনিটর: ১৯ ইঞ্চি বা ২২ ইঞ্চি মনিটর (আইপিএস প্যানেল হলে ভালো, কালার ঠিক দেখার জন্য)।
খ) প্রিন্টার (সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ)
কম্পিউটার দোকানের ব্যবসার প্রাণ হলো প্রিন্টার। সাধারণত দুই ধরনের প্রিন্টার লাগে:
- কালার প্রিন্টার: ছবি এবং রঙিন ডকুমেন্ট প্রিন্ট করার জন্য। বাংলাদেশে Epson L130, L3210, বা L805 (ফটো প্রিন্টিংয়ের জন্য সেরা) খুব জনপ্রিয়।
- সাদা-কালো লেজার প্রিন্টার: দ্রুত এবং কম খরচে টেক্সট প্রিন্ট করার জন্য। Canon 6030 বা HP LaserJet 107a ভালো অপশন।
গ) ফটোকপি মেশিন
যদি বাজেট কম থাকে তবে শুরুতে স্ক্যানার ও প্রিন্টার দিয়ে ফটোকপির কাজ চালাতে পারেন। তবে ব্যবসার পরিধি বাড়লে একটি Toshiba বা Canon ব্র্যান্ডের ফটোকপি মেশিন কেনা উচিত। এতে কালির খরচ অনেক কমে যায় এবং লাভের পরিমাণ বাড়ে।
ঘ) স্ক্যানার
ডকুমেন্ট ডিজিটাল করার জন্য ভালো মানের স্ক্যানার প্রয়োজন। ক্যানন বা এপসনের ফ্ল্যাটবেড স্ক্যানার (Flatbed Scanner) ব্যবহার করতে পারেন। অনেক প্রিন্টারের সাথে স্ক্যানার যুক্ত থাকে (All-in-One), শুরুতে সেটি দিয়েও কাজ চালানো যায়।
ঙ) ডিএসএলআর ক্যামেরা (স্টুডিওর জন্য)
যদি আপনি পাসপোর্ট সাইজ ছবি তোলার সেবা দিতে চান, তবে একটি ভালো মানের ক্যামেরা লাগবে। Canon 700D, 200D বা Nikon D5600 এর মতো মডেলগুলো স্টুডিওর জন্য পারফেক্ট। বাজেট কম থাকলে ভালো মানের স্মার্টফোন দিয়েও শুরুতে কাজ চালানো যায়।
চ) অন্যান্য জরুরি যন্ত্রপাতি
- ল্যামিনেটিং মেশিন: আইডি কার্ড বা সার্টিফিকেট প্লাস্টিক মোড়ানোর জন্য।
- আইপিএস/ইউপিএস: লোডশেডিংয়ে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য।
- ইন্টারনেট মডেম/রাউটার: নিরবচ্ছিন্ন হাই-স্পিড ইন্টারনেট।
- পেপার কাটার: ছবি বা কাগজ সোজা করে কাটার জন্য।
২. কম্পিউটার দোকানে কি কি সফটওয়্যার প্রয়োজন?
হার্ডওয়্যারের পাশাপাশি সঠিক সফটওয়্যার জানা এবং পিসিতে ইনস্টল রাখা জরুরি। কম্পিউটার ও ফটোকপির দোকানে কি কি কাজ হয় তা নির্ভর করে আপনার সফটওয়্যার দক্ষতার ওপর।
- MS Office (Word, Excel, PowerPoint): সিভি তৈরি, টাইপিং এবং হিসাব নিকাশের জন্য।
- Adobe Photoshop (7.0 বা CS/CC): ছবি এডিটিং, ব্যাকগ্রাউন্ড রিমুভ এবং স্টুডিও কাজের জন্য এটি অপরিহার্য।
- Bijoy 52 / Avro: বাংলা টাইপিংয়ের জন্য।
- Internet Browsers: Chrome বা Firefox (অনলাইন আবেদনের জন্য)।
- PDF Reader: ডকুমেন্ট প্রিন্ট করার জন্য।
✨ কম্পিউটার দোকানদারদের জন্য সিক্রেট টুল
দোকানে কাজের চাপ কমানোর জন্য এবং কাস্টমারকে দ্রুত সেবা দেওয়ার জন্য আধুনিক অনলাইন টুলস ব্যবহার করা বুদ্ধিমানের কাজ। যেমন:
ID Card Scan With Crop To Pdf Tool
সঠিকভাবে ডকুমেন্ট স্ক্যান করার জন্য অনলাইনে সেরা আইডি কার্ড ও পাসপোর্ট স্ক্যানার এই সেবা দিতে কম্পিউটার দোকানদারদের জন্য এই টুলটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আইডি কার্ড ও পাসপোর্ট এর কর্ণার ঠিক করতে এবং তাৎক্ষণিকভাবে png, jpg, pdf a4 আকারে কনভার্ট করতে এই বিনামূল্যের ID Card Crop Both Sides to PDF Convert Tool 👆 ব্যবহার করুন।
এটি ব্যবহার করলে ফটোশপে ম্যানুয়ালি ক্রপ করার সময় বাঁচবে এবং আপনি মোবাইল দিয়েই স্ক্যান করে সরাসরি প্রিন্ট দিতে পারবেন।
৩. কম্পিউটার দোকানের কাজের তালিকা: কি কি কাজ জানতে হবে?
আপনি যদি জানতে চান কম্পিউটার দোকানের কি কি অভিজ্ঞতা থাকতে হবে, তবে নিচের তালিকাটি দেখুন। এই কাজগুলোই আপনার আয়ের প্রধান উৎস হবে:
- অনলাইন আবেদন: সরকারি-বেসরকারি চাকরির আবেদন, স্কুলে ভর্তির আবেদন, পাসপোর্ট আবেদন।
- রেজিস্ট্রেশন সেবা: জন্ম নিবন্ধন আবেদন ও সংশোধন, এনআইডি (NID) কার্ড সংশোধন, টিন (TIN) সার্টিফিকেট খোলা।
- কম্পোজ ও প্রিন্টিং: বাংলা ও ইংরেজি টাইপিং, সিভি (Bio-data) তৈরি, প্রশ্নপত্র টাইপ, প্রত্যয়নপত্র তৈরি।
- ছবি ও স্টুডিও: পাসপোর্ট ও স্ট্যাম্প সাইজ ছবি তৈরি, ব্যাকগ্রাউন্ড পরিবর্তন, ছবি রিটাচিং।
- মোবাইল ব্যাংকিং: বিকাশ, নগদ, রকেটের এজেন্টশিপ নিয়ে ক্যাশ ইন/আউট ব্যবসা।
- রেজাল্ট ও এডমিট কার্ড: পরীক্ষার রেজাল্ট দেখা ও রঙিন এডমিট কার্ড প্রিন্ট করা।
- টিকিট বুকিং: ট্রেন, বাস বা বিমানের টিকিট কেটে দেওয়া।
৪. কম্পিউটার দোকান ব্যবসায় খরচ ও বাজেট ধারণা
ব্যবসাটি আপনি ছোট, মাঝারি বা বড়—তিনভাবেই শুরু করতে পারেন। কম্পিউটার দিয়ে কি কি ব্যবসা করা যায় তার ওপর ভিত্তি করে খরচ কমবেশি হতে পারে। নিচে একটি আনুমানিক খরচের তালিকা দেওয়া হলো:
| সরঞ্জাম/খাত | মিনিমাম বাজেট (টাকা) | মাঝারি বাজেট (টাকা) |
|---|---|---|
| দোকান অ্যাডভান্স ও ডেকোরেশন | ৩০,০০০ - ৫০,০০০ | ১,০০,০০০ - ১,৫০,০০০ |
| কম্পিউটার (১টি) | ২০,০০০ - ২৫,০০০ | ৩০,০০০ - ৪০,০০০ |
| কালার প্রিন্টার (Epson) | ১৮,০০০ - ২০,০০০ | ২৫,০০০ - ৩০,০০০ |
| লেজার প্রিন্টার/ফটোকপি | ১২,০০০ (শুধুমাত্র প্রিন্টার) | ৬০,০০০+ (ফটোকপি মেশিন) |
| ডিএসএলআর ক্যামেরা (অপশনাল) | - | ২৫,০০০ - ৩৫,০০০ (সেকেন্ড হ্যান্ড) |
| অন্যান্য (স্ক্যানার, ল্যামিনেটিং) | ৫,০০০ | ১০,০০০ |
| মোট আনুমানিক খরচ | ৮৫,০০০ - ১,০০,০০০ | ২,৫০,০০০ - ৩,০০,০০০ |
নোট: বাজার দর অনুযায়ী এই দাম পরিবর্তন হতে পারে। আপনার যদি আগে থেকেই কম্পিউটার থাকে, তবে খরচ অর্ধেকে নেমে আসবে।
৫. কম্পিউটার দোকানের ব্যবসা থেকে ইনকাম কেমন হয়?
এটি সম্পূর্ণ নির্ভর করে আপনার দোকানের লোকেশন এবং আপনি কি কি সেবা দিচ্ছেন তার ওপর। অনলাইন কম্পিউটার দোকানে ব্যবসার বৃদ্ধি ও লাভজনকতা অনেক বেশি যদি আপনি সৎ এবং দক্ষ হন।
- ফটোকপি ও প্রিন্ট: প্রতিদিন গড়ে ৫০০-১০০০ টাকা লাভ করা সম্ভব।
- অনলাইন আবেদন: প্রতিটি আবেদনে ৫০-১০০ টাকা সার্ভিস চার্জ নেওয়া যায়। সিজনের সময় (যেমন পুলিশ বা প্রাইমারি নিয়োগ) দিনে ২০-৩০টি আবেদন করা সম্ভব।
- ছবি তোলা: পাসপোর্ট সাইজ ৪ কপি ছবিতে খরচ ৫ টাকা, কিন্তু বিল নেওয়া যায় ৫০-৬০ টাকা। এখানে লাভ সবথেকে বেশি।
- মোবাইল ব্যাংকিং: লেনদেনের ওপর হাজারে ৪-৫ টাকা কমিশন থাকে।
সব মিলিয়ে একটি ভালো লোকেশনে দোকান দিতে পারলে মাসে ২৫,০০০ থেকে ৫০,০০০ টাকা আয় করা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।
৬. দোকানের লোকেশন ও ডেকোরেশন
কম্পিউটার দোকানের ডেকোরেশন আকর্ষণীয় হওয়া উচিত, কিন্তু তার চেয়ে বেশি জরুরি হলো লোকেশন।
- স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে।
- পাসপোর্ট অফিস, আদালত বা সরকারি অফিসের আশেপাশে।
- জনবহুল বাজার বা বাসস্ট্যান্ড এলাকায়।
ডেকোরেশনের জন্য একটি গ্লাস কাউন্টার, কাস্টমার বসার জন্য বেঞ্চ বা টুল এবং পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা রাখুন। দেয়ালের রঙ হালকা হলে দোকান বড় ও উজ্জ্বল দেখায়।
৭. অনলাইন কম্পিউটার দোকানে কাস্টমার সার্ভিস ও বিক্রয় কৌশল
দোকান দিলেই কাস্টমার আসবে না, ব্যবহার দিয়ে কাস্টমার ধরে রাখতে হবে।
- দ্রুত সেবা: টাইপিং স্পিড ভালো রাখুন। কাস্টমার বসিয়ে রাখলে বিরক্ত হয়।
- ব্যবহার: গ্রামের বা কম জানা মানুষ অনেক সময় বিরক্তিকর প্রশ্ন করতে পারে, তাদের সাথে শান্তভাবে কথা বলুন।
- গোপনীয়তা: মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য (NID, ছবি) সুরক্ষিত রাখুন।
- প্রচারের ব্যবস্থা: দোকানের সামনে একটি বড় সাইনবোর্ড দিন যেখানে "এখানে সব ধরনের অনলাইনের কাজ করা হয়" লেখা থাকবে।
শেষ কথা
নিজের এলাকায় কম্পিউটার কম্পোজের দোকান দেওয়া একটি সম্মানজনক এবং স্বাধীন পেশা। শুরুতে হয়তো কাজ কম থাকতে পারে, কিন্তু পরিচিতি বাড়লে এবং আপনার কাজের মান ভালো হলে কাস্টমারের অভাব হবে না।
প্রযুক্তি প্রতিনিয়ত আপডেট হচ্ছে, তাই নিজেকেও নতুন নতুন কাজের সাথে আপডেট রাখতে হবে। আপনি যদি ধৈর্য ধরে কাজ করতে পারেন এবং উপরের গাইডলাইন মেনে চলেন, তবে এই ব্যবসায় আপনি সফল হবেন ইনশাআল্লাহ।